ভালোবাসা নিয়ে কিছু কথা: না ভালোবাসাকে আমরা দেখতে পাই, না শুনতে পাই, না কোনো ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বুঝতে পারি। তাহলে ভালোবাসা মানে কি ?
আসলে, ভালোবাসা হল মনের অনুভূতি, যা হল কেবলমাত্র অনুভব করারই ব্যাপার।
অথচ, সারা বিশ্ব চলে এই ভালোবাসার দাসত্বেই।
এই ভালোবাসার আছে অবর্ণনীয় রূপ, রস, গন্ধ বর্ণ, কিন্তু তার কোনোটাই পঞ্চ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়।
তাই, আজকে আমরা এই আর্টিকেলে বলবো ভালোবাসা নিয়ে কিছু কথা, যা যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই গ্রাউন্ড রুল হিসেবে বিবেচিত হয়।
একটা সুস্থ সম্পর্ক পরিচালনা করা মোটেই কোনো সহজ কথা নয়।
মানুষের ক্রোধ, লোভ, কাম, অহংকার, আসক্তি, ও ঈর্ষা হল তার চির শত্রু।
এই চারিত্রিক দোষের উপস্থিতিই কিন্তু যেকোনো সম্পর্কের ইতি ঘটাতে পারে।
তাই, ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রত্যেক মানুষের উচিত কিছু সাধারণ কাজ ও অকাজ যথাক্রমে মেনে ও এড়িয়ে চলা।
যদিও মানুষ ভুল করে আর সেই ভুল থেকেই শিক্ষা নিয়ে থাকে।
আর, আমাদের মনে রাখা উচিত, কোনো সম্পর্কই কিন্তু কখনও নিখুঁত হতে পারে না।
একমাত্র দুটি মনের সহাবস্থানেই কিন্তু ভালোবাসার শুভ পরিণতি সম্ভব।
প্রেম ও ভালোবাসা নিয়ে কিছু কথা এবং চর্চা
চলুন, তাহলে জেনে নেওয়া যাক প্রেম ও ভালোবাসা সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্বন্ধে।
১. মন খুলে কথা বলুন:
মানুষ যদি সবসময় একে অপরের মুখ দেখে মনের কথা বুঝতে পারতো, তাহলে কতই ভালো হতো, তাই না ?
কিন্তু, মানুষের সেই ক্ষমতা এখনও প্রায় অধরাই।
তাই, একটা সুস্থ সম্পর্কের প্রথম ভিত্তিই হল মন খুলে একে অন্যের সাথে কথা বলা।
মানুষ যদি মনের মধ্যে গভীর চিন্তা না করে নিজের মনের কথা মনের মানুষকে খুলে বলে, তাহলে সহজেই কিন্তু অনেক ভুল বোঝাবুঝি থেকে নিস্তার পাওয়া যায়।
ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে মতবিরোধ হলে, মন খুলে কথা বলে সেই মতবিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন নিজেদের মধ্যে।
এখানে কখনোই কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে দেবেন না।
২. নিজের স্বত্তাকে বিসর্জন দেবেন না:
ভালোবাসা মানে একেবারেই নিজের আত্মা, বিবেক বা স্বত্তাকে বিসর্জন দেওয়া নয়।
ভালোবাসার মানুষকে নিজের সবটুকু দিয়ে অবশ্যই ভালোবাসুন, তাই বলে আপনার পছন্দ বা অপছন্দগুলোর সাথে কখনওই আপোষ করবেন না।
কারণ, আপনি যেমন আছেন, আপনার ভালোবাসার মানুষটিও আপনাকে সেইভাবেই গ্রহণ করেছেন।
সেই কারণেই, ভালোবাসা মানে আপনার প্রিয় মানুষটি হল আপনার নিজস্ব জগতের একটা অংশ মাত্র, সে আপনার সমগ্র জগৎ কিন্তু নয়।
তাই, ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকে কখনও হারিয়ে ফেলবেন না।
৩. ভালোবাসা মানেই হল অসংখ্য প্রচেষ্টা:
ভালোবাসতে অনেকেই জানে, কিন্তু ভালোবাসা দিনের পর দিন ধরে রাখতে কত জন জানে ?
শুধুমাত্র ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে ভালোবাসাকে ধরে রাখা যায় না।
ভালোবাসা হল একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মতো।
যে পরিকল্পনা সফল করতে গেলে লাগে অনেক সময় ও ধৈর্য।
ভালোবাসার সম্পর্ককে ধরে রাখার জন্যে লাগে রোমান্স টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি ভালোবাসা ধরে রাখায় নতুন নতুন প্রচেষ্টা।
যাতে, ভালোবাসার মধ্যে কোনো একঘেঁয়েমি জায়গা করে না নিতে পারে।
৪. ঝগড়ার সময় বিজেতার মনোভাব ত্যাগ করুন:
ভালোবাসা কোনো উত্তেজক খেলা নয়, যেখানে প্রতিপক্ষকে না হারালে মান-সম্মান থাকবে না।
বরং, ভালোবাসা হল একধরণের মধ্যস্থতার সম্পর্ক, যেখানে দুই পক্ষই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ আর দুটি মানুষই একই দলের লোক, আর সেই দলের নামই হল ভালোবাসা।
তাই, যখনই ঝগড়া হোক, চরম রাগ হোক সেই প্রিয় মানুষটার উপর, ভুল যতই তার থাকুক, তবুও কোনোভাবেই কোনো ঝগড়াতে নিজে জিতবেন বলে, তাকে একদম কষ্ট দেবেন না।
তাহলে কিন্তু আপনার ভালোবাসারই হার হবে, আর কিছু না।
৫. ভালোবাসায় প্রতারণা হল ঘোর অপরাধ:
কাচ ভাঙা আর বিশ্বাস ভাঙা অনেকটাই একরকমের, তাই না ?
দুটো ভাঙলে হয়তো কোনোভাবে জোড়া গেলেও, ভাঙার দাগগুলো কিন্তু রয়েই যায়।
তাই, ভালোবাসার ক্ষেত্রে সঙ্গীর বিশ্বাস ভাঙা বা প্রতারণা কিন্তু সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ারই সমান।
এই জন্যে সবসময় মনে রাখবেন, একটামাত্র প্রতারণাই কিন্তু আপনার ভালোবাসা এক নিমেষে ভেঙে দিতে সক্ষম।
৬. নিজের সঙ্গীর সাথে অন্যের তুলনা করবেন না:
আপনি যখন আপনার ভালোবাসার মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তখন কোনো কারণ দেখেই নিশ্চয়ই আকর্ষণ বোধ করেছিলেন।
তাই মনে রাখবেন, আপনার প্রিয় মানুষকে অন্য কারুর সাথে তুলনা করা বোকামি।
এই পৃথিবীতে সব মানুষের চিন্তাভাবনা কখনোই সম্পূর্ণভাবে এক হতে পারে না।
সেক্ষেত্রে, আপনার প্রিয় মানুষটার সাথে অন্য কারোর তুলনা করা কখনোই উচিত নয়।
প্রতিটা মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে, সেটা পরিবর্তন করতে গেলে, অনেকক্ষেত্রেই ভালোর বদলে খারাপই হয়।
আপনি খুব বেশি হলে, ধীরে ধীরে একে অপরের সম্পর্কে অপছন্দের জিনিসগুলো পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে পারেন।
৭. আপনার সঙ্গীকে আপনার আদর্শ মানুষ হিসেবে কল্পনা করে নেবেন না:
মানুষের ভালোবাসা ও ভালোবাসার মানুষ নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন থাকে।
কিন্তু, বাস্তবের সাথে সেই স্বপ্ন অনেক সময়েই মেলে না।
তখন মানুষের শঙ্কা হয় যে সেই ভালোবাসার মানুষটিই কি আসলে তার স্বপ্নের মানুষ ?
তাই, আমাদের মতে, এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই।
আসলে, ভালোবাসা হল একে অপরকে ধীরে ধীরে বোঝা এবং একে অপরের ভালোবাসার খাতিরে নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়ে চলা।
আর, ভালোবাসা হল একটা প্রক্রিয়ার মতো, যেখানে ভবিষ্যতের বিষয়ে চিন্তা না করে, আপনাদের উচিত অবশ্যই একসাথে নিজেদেরকে বিকশিত করে তোলা।
৮. নিজেকে ভালোবাসুন সবার আগে:
নিজেকে ভালোবাসলে তবেই না আপনার পৃথিবীটাকে সুন্দর লাগবে!
আর অন্য মানুষকে আপনি ভালোবাসতেও পারবেন।
নিজেকে ভালোবেসে গ্রহণ করতে শিখলে, আপনি জীবনের সব ব্যাপারেই ধৈর্যশীল হয়ে উঠবেন।
তখন দেখবেন, কেউ যদি আপনাকে দুটো খারাপ কথাও শুনিয়ে দেয়, তবে আপনি তা থেকে সহজেই নিজের মনকে স্বান্তনা দিয়ে খুশি থাকতে পারবেন।
৯. মতামত চাপানোর কিংবা জোর করে অপরের মতামত মেনে নেবেন না:
ভালোবাসার আরেক নাম কিন্তু পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রাখা।
তাই, চেষ্টা করবেন জোর করে নিজের মতামত আপনার প্রিয় মানুষটির ঘাড়ে না চাপাতে।
আবার, অন্যদিকে তাকেও আপনার মতামতের উপর হস্তক্ষেপ করতে দেবেন না।
নিজেদের মধ্যে স্বাধীনভাবে ও সুস্থভাবে মতামতের মধ্যস্থতা করাই ভালো।
১০. ভালোবাসার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকুন:
যখন একজন মানুষের মানসিক ও শারীরিক ভরসার উপর আপনি নির্ভরশীল থাকেন, তখন সেই মানুষটির মধ্যেও কিন্তু আপনার চিন্তাভাবনার প্রভাব ও তার অংশ বিশেষও বয়ে চলে।
তাই, আমাদের উচিত আমাদের সঙ্গীর কাছে সবসময় কৃতজ্ঞ থাকা।
কারণ, আপনি কোনো না কোনোভাবে মানসিক দিক থেকে তার উপর নির্ভরশীল থাকেন।
এই ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গীর প্রতি আমাদের যে কৃতজ্ঞতা বোধ রয়েছে, সেটা আমাদের তাদেরকে বোঝানো উচিত।
১১. সবসময় সঙ্গীর সমালোচনা করা বন্ধ করুন:
পৃথিবীর কোনো মানুষই কোনোদিন নির্ভুল হতে পারে না।
সেই জন্যে মানুষের উচিত ছোট-বড় যেকোনো ভুলেই অপর মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়া।
ক্রমাগত সেই মানুষের ভুলের সমালোচনা, কিন্তু তার মন ভেঙে দিতে পারে।
তবে, এই সমালোচনা গুলো কিন্তু আসলেই আপনার ভালোবাসার সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরাতে সক্ষম হতে পারে, যদি আপনি নিজেই সেই সুযোগ করে দেন।
১২. সমঝোতা করে চলতে শিখুন:
ভালোবাসার সম্পর্কে সমঝোতা করে চলা হল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।
কারণ, এই সমঝোতা করার মানসিকতা থাকা মানে আপনি আপনার ভালোবাসা ও সঙ্গীর স্বার্থে যেকোনো ধরণের কাজ করতে পারবেন।
এর থেকে আপনার সঙ্গী অনুমান করতে পারবেন, যে আপনি তার অনুভূতি এবং ইচ্ছাকে সম্মান করছেন কিনা।
এই সমঝোতার মনোভাব তাদের নিশ্চিন্ত করে, যে তারা আপনার কাছে মূল্যবান এবং সম্পর্কটি কেবল একতরফাও নয়।
১৩. ভালোবাসার মানুষকে অবজ্ঞা করা অনুচিত:
সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সূত্র হল অবজ্ঞা।
যদিও, একজন ব্যক্তির পক্ষে একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সম্পর্কের সমস্ত ভার বহন করা স্বাভাবিক হতে পারে।
তবে, একটানা সম্পর্কে মানুষ বিরক্ত হয়ে যেতে পারে।
কিংবা, অনেক সময় তাদের মধ্যে অন্যান্য নেতিবাচক অনুভূতি তৈরিও হতে পারে।
তখন তাদের উচিত, এই ব্যাপারগুলোকে অবজ্ঞা না করে সরাসরি তার সঙ্গীর সাথে আলোচনা করা এবং উপশমের রাস্তা খোঁজা।
১৪. গোপনে তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নজর দেওয়া বন্ধ করুন:
প্রতিটা মানুষের তার নিজস্ব একটা জগৎ থাকে এবং থাকা উচিতও।
সেই জগতে মানুষেরা অযাচিত কারোর অনুপ্রবেশ পছন্দ করে না।
তাই, আপনার সঙ্গীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন আর তাকে সন্দেহ করা ছাড়ুন।
তার আড়ালে তার ফোন ঘাঁটা, কিংবা তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে হাত দেওয়া বন্ধ করুন।
যদি এইসব কাজ করতে গিয়ে কোনোদিন সঙ্গীর কাছে ধরা পড়েন, তবে সম্পর্কের টান কিন্তু সেখানেই নষ্ট হয়ে যাবে।
১৫. মনে ক্ষোভ পুষে রাখবেন না:
একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পোষণ করা কিন্তু ভালোবাসে সম্পর্কের জন্যে খুবই খারাপ একটা বিষয়।
আপনাদের দুজনের মধ্যে কেউ হয়তো অনৈতিক কিছু করার জন্য একেবারেই অনুতাপ করেন না এই ভেবে যে, তাদের সঙ্গী আগেও একই রকম কিছু একটা খারাপ কাজ করেছিল।
তাই, নিজের ভালোবাসার মানুষের করা ভুলের কারণে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে আপনিও সেই এক ভুল তার উপর করলে, সেটা কিন্তু আপনার সম্পর্কের মর্যাদা কোনোভাবে বাড়ায় না, বরং ভালোবাসার গুরুত্ব একেবারে কমিয়ে দেয়।
সবশেষে:
ভালোবাসা শব্দটা দেখতে শুনতে সহজ মনে হলেও, আদতে কিন্তু ভালোবাসা হল পুরোটাই জটিল ও শর্তবিহীন একটা অনুভূতি।
তাই, সম্পর্কের বা ভালোবাসার মধ্যে ঠিক-ভুল পুরো ব্যাপারটাই শর্ত সাপেক্ষ।
তবে, একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান ও সততা বজায় রাখতে পারলে, ভালোবাসা কোনোদিনও মানুষকে ছেড়ে যায় না।
আমাদের আজকে ভালোবাসা নিয়ে বলা কিছু কথা গুলো বা আলোচনা এখানেই শেষ হল।
লেখাটি ভালোলাগলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।