মানসিক চাপ কমানোর উপায়: বর্তমানে, স্ট্রেস বা উদ্বেগ বহু মানুষের কাছেই সাধারণ একটা অভিজ্ঞতাতে পরিণত হয়েছে।
এমন বহু মানুষ রয়েছেন, যারা দৈনন্দিনভাবে স্ট্রেস বা মানসিক চাপের মোকাবেলা করে চলেছেন।
নিত্যদিনকার জীবনে মানুষ; মূলত কাজ-সংক্রান্ত, স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ, পারিবারিক সমস্যা, আর আর্থিক বাধ্যবাধকতাগুলো নিয়ে চরম মাত্রায় স্ট্রেসড বা উদ্বিঘ্ন বোধ করে থাকেন।
Post Contents
আসলে, এই স্ট্রেস জিনিসটা কি ?

স্ট্রেস বা মানসিক চাপ হল এক ধরণের শারীরবৃত্তীয় ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া।
এই প্রতিক্রিয়া মানুষের শরীর ও মনের উপর নেতিবাচক বা ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
এই ধরণের মানসিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়ার ফলে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি;
যেমন- হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া, হতাশ হয়ে যাওয়া কিংবা শারীরিক বা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া।
আর, আমরা প্রায়ই এই ধরণের স্ট্রেস থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে নানা রকমের চেষ্টা করে থাকি।
আমাদের এই মানসিক চাপ কমানোর জন্যে কিন্তু বেশ অনেক রকম উপায়ও আছে।
তাই, আজকে আমাদের এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো, মানসিক চাপ কমানোর সেরা উপায় সম্পর্কে।
মানসিক চাপ কমানোর উপায় – (সেরা ৯টি)
স্ট্রেস কম করতে আমরা এখানে সেরা কয়েকটি টিপস নিয়ে আলোচনা করবো, যেগুলো মেনে চললে আপনার জীবনে মানসিক চাপ পরিচালনা করা যথেষ্ট সহজ হয়ে উঠবে –
১. নির্দেশিত ধ্যান করুন:
প্রতিদিনের জীবনের মানসিক চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে গাইডেড মেডিটেশন বা নির্দেশিত ধ্যান হল একটা দুর্দান্ত উপায়।
বর্তমানে, ইন্টারনেটে অনেক গাইডেড মেডিটেশনের টিউটোরিয়াল রয়েছে।
কিংবা, আপনি কোনো পার্সোনাল ট্রেনারের সাথে যোগাযোগ করে সহজেই স্ট্রেস কমাবার ধ্যান শিখে নিতে পারেন।
নিয়মিত ধ্যান করলে সত্যিকারেই চাপ কমানো সম্ভব।
২. পর্যাপ্ত মাত্রায় ঘুমোন:
ঘুম হল যেকোনো সমস্যার প্রধান প্রতিকার।
মন কিংবা শরীর খারাপ লাগছে? তাহলে, যদি একটু ঘুমিয়ে নেন, দেখবেন মন ও শরীর দুটোই ঝরঝরে লাগছে।
অনেক সময়, দিনের পর দিন ঘুমের ঘাটতি হলেও, সেটা আপনার মনে নেতিবাচক অনুভূতি তৈরী করতে পারে।
এর ফলে, আপনার মুড খারাপ থাকতে পারে, এনার্জি কমে যেতে পারে কিংবা শারীরিকভাবে দুর্বলবোধও করতে পারেন।
এইসব সমস্যা থেকেই কিন্তু মূলত স্ট্রেস তৈরী হতে পারে।
এই কারণেই, এইসব ঝামেলা এড়াতে সারাদিনে কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমোন।
৩. গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন করুন:
গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে আপনার সহানুভূতিশীল স্নায়ুতন্ত্র কম সক্রিয় হয়।
ফলে, স্নায়ুতন্ত্র শিথিল হলে, আপনার স্ট্রেসের কারণে তৈরী হওয়া ক্ষতিকারক শারীরিক প্রতিক্রিয়াও সহজে নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।
পাঁচ সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে গভীর শ্বাস নিয়ে, দুই সেকেন্ডের জন্য ধরে রেখে ও পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় ছেড়ে দিলে, আপনার প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র সহজেই সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এর ফলে, আপনি সামগ্রিক চাপ ও উদ্বেগ থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হতে পারেন।
৪. পুষ্টিকর ডায়েট মেনে চলুন:
আপনার খাদ্যাভাস সরাসরি আপনার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।
সমীক্ষায় দেখা যায় যে, যেসব ব্যক্তি অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার ও চিনিযুক্ত খাবারের ডায়েট অনুসরণ করেন, তারা সাধারণত উচ্চতর মানসিক চাপ বোধ করেন।
দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপে থাকলে মানুষের অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।
যা মানুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও মেজাজের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
এছাড়াও, পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ার জন্যে পুষ্টির ঘাটতি হলেও, তা আপনার মনে উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
তাই, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ফাইবার, ভিটামিন ও মিনারেলস সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবারই আমাদেরকে স্ট্রেস থেকে দূরে রাখতে পারে।
৫. প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্টস খান:
বেশ কিছু ভিটামিন ও মিনারেলস রয়েছে, যা আপনার শরীরের চাপের প্রতিক্রিয়া ও মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে।
আপনার শরীরে এক বা একাধিক পুষ্টির ঘাটতি হলে, আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ও স্ট্রেস কমানোর ক্ষমতাও কমে যেতে পারে।
এছাড়াও, নানান গবেষণায় দেখে গেছে যে, কিছু খাদ্যতালিকাগত সাপ্লিমেন্ট আমাদের মানসিক চাপ কমাতে ও মেজাজ ভালো করার জন্যে সাহায্য করতে পারে।
যেমন – আপনার শরীরে ম্যাগনেসিয়ামের মাত্রা কমে গেলে, অনেক সময়ে আপনি মানসিক চাপে ভুগতে পারেন।
অশ্বগন্ধা, বি ভিটামিন, রডিওলা কিংবা এল-থেনাইনের মতো সাপ্লিমেন্টগুলো স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করা দেখা গেছে।
তবে, মানসিক চাপ কমাতে সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করার আগে একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত।
৬. শরীরচর্চা করুন:
নিয়মিত শরীরচর্চা চাপের প্রতিক্রিয়া কমানোর জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে।
আপনি যদি শরীরের দিক থেকে সুস্থ থাকেন, তাহলে আপনার মনও সুস্থ থাকে।
যেকোনো ধরণের শরীরচর্চাই ব্যাপকভাবে স্ট্রেস রিলিভার হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এছাড়াও, এক্সারসাইজ করলে আপনার সামগ্রিক জীবনের মানও উন্নত হয়।
৭. নিজের যত্ন নিন:
আমরা যখন স্ট্রেসড হয়ে যাই, তখন আমাদের স্নায়ুও ব্যাপকভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
এই সময়ে, আপনার স্নায়ুকে ঠান্ডা করার জন্যে আপনার প্রয়োজন নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া।
মানসিক চাপ কমাতে আপনি আপনার পছন্দের গান শুনতে পারেন।
কোনো গল্পের বই পড়তে পারেন বা কোনো সেন্টেড ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে মেডিটেশানও করতে পারেন।
কিংবা, সুন্দর একটা স্পা বা ম্যাসাজও নিজেকে উপহার দিতে পারেন।
নিজের মনকে শান্ত রাখতে একটা সুন্দর ওয়াক বা ড্রাইভেও যেতে পারেন।
একটা গরম বা ঠান্ডা শাওয়ারও কিন্তু স্ট্রেস থেকে আপনাকে মুক্ত করে তুলতে পারে।
৮. স্ক্রিন-টাইম কমিয়ে ফেলুন:
সোশ্যাল মিডিয়া সাইট গুলিতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় কাটানো চাপের বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ট্যাবলেট গুলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনিবার্য অংশ হলেও, এইগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার করা আপনার মানসিক চাপের মাত্রাকে বাড়াতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, অত্যধিক স্মার্টফোন ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের চূড়ান্তভাবে ক্ষতি করছে।
সাধারণভাবে, স্ক্রিনের সামনে অত্যধিক সময় ব্যয় করলে, মানুষের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা বাড়িয়ে চাপের মাত্রা বৃদ্ধি করে দেয়।
এছাড়াও, বেশিক্ষণ স্ক্রিনের সামনে সময় ব্যয় করলে, তা আপনার ঘুমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে; যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে।
৯. নিজের পরিবার-পরিজনের সাথে সময় কাটান:
মানুষ হল সামাজিক জীব।
তাই, সঙ্গ পাওয়ার জন্যে অবশ্যই আপনার মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখা দরকার।
অনেক সময়েই পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে পাওয়া সামাজিক সমর্থন আপনাকে স্ট্রেস কাটিয়ে উঠতে ও এটিকে মোকাবেলা করতে সাহায্য করে।
একটি সামাজিক সাপোর্ট সিস্টেম থাকা মানে আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকা।
আপনার নিজেকে একা অনুভব হলে, কিংবা আপনার যদি বন্ধুবান্ধব বা পরিবার না থাকে, তবে নানান সোশ্যাল সাপোর্ট গ্রুপের সাথে অবশ্যই যোগাযোগ করতে পারেন।
এছাড়াও, আপনি কোনো ক্লাব বা স্পোর্টস টিমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন, আপনার স্ট্রেসের মাত্রাকে কমানোর জন্যে।
এক্সট্রা টিপস:
যদিও মানসিক চাপ আমাদের জীবনের একটা অবশ্যম্ভাবী অংশ।
আর, দীর্ঘকালীন স্ট্রেস আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে।
তবে, আপনার কোনো পোষ্য থাকলে তার সাথে সময় কাটালেও আপনার মানসিক চাপ কিছুটা কমতে পারে।
নিজের মনকে হালকা করতে মাঝেমধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি হেঁটে আসুন।
এমনকি, আপনি আপনার কাজের ক্ষেত্রে যেটুকু আপনার পরিচালনা করার ক্ষমতা রয়েছে, সেটুকু গ্রহণ করে বাকিটাকে না বলার চেষ্টা করুন।
অতিরিক্ত কাজকে না বলাটা কোনো অপরাধ নয়।
তাই, না বলাটা হল আপনার জীবনের মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা ভালো উপায়।
অনেক সময় আমরা কাজের ফাঁকে অনেক বেশি পরিমাণে চা বা কফি খেয়ে ফেলি।
কফিতে থাকা ক্যাফিন ও চায়ে থাকা ট্যানিন আমাদের স্ট্রেস ও উদ্বেগ অত্যধিক বাড়িয়ে দিতে পারে।
তাই, অতিরিক্ত পরিমাণে কফি বা চা খাওয়া বন্ধ করুন।
এছাড়াও, আলিঙ্গন, চুম্বন ও প্রিয় মানুষের ইতিবাচক স্পর্শ স্ট্রেস-রিলিভিং অক্সিটোসিন হরমোন ক্ষরণ করতে সাহায্য করে।
যা আপনার রক্তচাপ কমিয়ে স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করতে পারে।
আমাদের আজকের মানসিক চাপ কমানোর উপায় নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হল।
লেখাটি পছন্দ হলে অবশ্যই তা কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।